আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ফেরাতে হলে বিদেশে অর্থ-পাচার আবারো চাঙ্গা হয়েছে কিনা নজর দিতে হবে :: হাসিনার শাসনকালের গত সাড়ে পনেরো বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি-লুন্ঠনের মহোৎসব-কাল :: গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী কয়েক মাসে দেশের অর্থনীতি ‘মেল্টডাউন’ এড়াতে সক্ষম হয়েছে প্রধানত বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সের জোয়ার, রফতানির প্রবৃদ্ধি এবং আমদানি-ব্যয়ের স্থিতিশীলতার কারণে। এই তিনটি ইতিবাচক ধারাকে নস্যাৎ করার জন্য একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান কঠোর মনিটরিং শিথিল করা যাবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়োচিত নীতি-পরিবর্তনে অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে গতি সঞ্চার হচ্ছে

Daily Inqilab ॥ ড. মইনুল ইসলাম ॥

১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম


বেশ কয়েক মাস রেমিট্যান্সের ডলারের ক্ষেত্রে টাকার অঙ্কে ডলারের দাম ১২১ থেকে ১২২ টাকায় স্থিতিশীল থাকার পর গত মাসে তা আবার নাটকীয়ভাবে বেড়ে ১২৭ থেকে ১২৮ টাকায় পৌঁছে গিয়েছিল। এটা বিপজ্জনক প্রবণতা। কেননা এরফলে মুল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রয়াস ভ-ুল হয়ে যাবে। এই হঠাৎ বৃদ্ধির জন্য এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির অজুহাত তুলে ধরেছে। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে যে, দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি-পাচার আবার চাঙ্গা হতে শুরু করার সুস্পষ্ট লক্ষণ ফুটে উঠেছেÑ রেমিট্যান্স ডলারের এহেন দামের উল্লম্ফনের মধ্য দিয়ে। এরজন্য বক্ষ্যমান কলামের প্রথমেই আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, পুঁজি-পাচারের বিষয়ে আরো কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করতে। পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ লাই পেয়ে গত এক দশকে বিদেশে পুঁজি-পাচার দেশের অর্থনীতিতে ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক উন্নয়নের খেসারত হলো আঠারো লক্ষ কোটি টাকা ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভুয়া বয়ান সৃষ্টির পাশাপাশি বেলাগাম পুঁজি-লুন্ঠন ও বিদেশে পুঁজি পাচারের এক অবিশ^াস্য রেকর্ড সৃষ্টি।

শেখ হাসিনার সময়ে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়েছিল সেটা ছিল ঋণ করে ঘি খাওয়ার ক্লাসিক উদাহরণ। ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে হাসিনা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। হাসিনা তার স্বৈরাচারী শাসনামলে তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদেরকে সাথে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুন্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তার ভয়াবহ কাহিনী তার পতনের পর উদঘাটিত হতে শুরু করেছে। ২০২৪ সালের ৭ আগস্ট দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের দাবি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র দুই লাখ ৭৬ হাজার ৮শ’ ৩০ কোটি টাকা।

এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অংকের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ১৫ লক্ষ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল ১৮ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতি বছর মাথাপিছু জিডিপি’র উচ্চ-প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন। যাকে বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভঙ্করের ফাঁকি’ ও জনগণের সাথে ভয়ানক প্রতারণা। ফলে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রতিজন বাংলাদেশীর মাথার ওপর এক লক্ষ টাকারও বেশি ঋণ নিজেদের অজান্তেই চেপে বসে গেছে। কমপক্ষে আগামী এক দশক ধরে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ডুবে থাকবেÑ এই বিশাল অঙ্কের ঋণের সুদ-আসলে কিস্তি পরিশোধের দায় মেটানোর কারণে। হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে তরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগা-প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগা-প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন-চার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা। যেজন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশে^র সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গত সাড়ে ১৫ বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজি-লুন্ঠনের মহোৎসব-কাল।

গত ২০২৪ইং সালের ৫ আগস্ট হাসিনার স্বৈরশাসনের উৎখাতের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৮ আগস্ট ২০২৪ইং তারিখে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে। আগস্টের ২৯ তারিখে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি শে^তপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। কমিটি গত ১ ডিসেম্বর ২০২৪ইং তারিখে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের শে^তপত্রটির খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। শে^তপত্রটির শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘উন্নয়ন বয়ানের ব্যবচ্ছেদ’ (ডিসসেকশান অব এ ডেভেলাপমেন্ট নেরেটিভ)। ড. দেবপ্রিয় হাসিনার শাসনামলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘চামচা পুঁজিবাদ’ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) থেকে সরাসরি ‘চোরতন্ত্রে’ (ক্লেপ্টোক্রেসি) রূপান্তরিত হয়েছেÑ এমনটি দাবি করেছেন।

হাসিনা তার স্বৈরাচারী শাসনামলে তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদেরকে সাথে নিয়ে সরকারি খাতের প্রকল্প থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুন্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। এই পুঁজি-লুন্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনা-পুত্র জয়, রেহানা-কন্যা টিউলিপ ও রেহানা-পুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও তার পুত্র শেখ ফাহিম, শেখ হেলাল, তার ভাই শেখ জুয়েল ও তার পুত্র শেখ তন্ময়, সেরনিয়াবাত হাসনাত আবদুল্লাহ ও তার পুত্র সাদিক আবদুল্লাহ, শেখ তাপস, শেখ পরশ, লিটন চৌধুরী ও নিক্সন চৌধুরী এবং হাসিনার অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। আর ছিল এস আলম, সালমান এফ রহমান, সামিটের আজিজ খান, বসুন্ধরার আকবর সোবহান, ওরিয়ন গ্রুপের ওবাইদুল করিম ও নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের মতো লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার লুটেরা রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা।

শে^তপত্র কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুন্ঠিত হয়ে দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি লুন্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সিয়াল খাত, তারপর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্য প্রযুক্তি খাত। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত এবং কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ সবচেয়ে বেশি অর্থ-পাচারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। লুটেরা রাজনীতিবিদদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় অলিগার্ক ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের খেলোয়ার, দুর্নীতিবাজ আমলা, ঠিকাদার ও মধ্যস্বত্বভোগী, হাসিনার আত্মীয়-স্বজন এবং ‘ইনফ্লুয়েন্স প্যাডলার’ ও ‘হুইলার-ডিলাররা’ এই লুটপাটতন্ত্রের প্রধান খেলোয়ার। এই লুটেরারা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে দেশের নির্বাহী বিভাগ, সিভিল প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহ, সরকারি রাজস্ব আহরণ বিভাগসমূহ ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগসমূহকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফায়দা হাসিলের অংশীদার করে ফেলেছে। দেশের বিনিয়োগ ও রাজস্ব আহরণকে এরা দুর্বল করে ফেলেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস নামিয়েছে, দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনকে তছনছ করে দিয়েছে।

হাসিনার স্বৈরশাসন উৎখাতের পর মাত্র কয়েকজন ব্যতীত উপরে উল্লিখিত লুটেরা ও পুঁজি পাচারকারীদের প্রায় সবাই নানাভাবে দেশ থেকে বিদেশে পালিয়ে গেছে। কয়েক লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে এই সব পলাতক লুটেরারা একেকজন দেশের আন্তর্জাতিক সীমানার নানা গোপন পথে বিজিবি-বিএসএফ এবং সংগঠিত চোরাকারবারী-সিন্ডিকেটের মদদে প্রধানত ভারতে পাড়ি দিয়েছে।

ইতোমধ্যে কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এখন তাদের বেশিরভাগেরই সাময়িক অর্থ-সংকটে পড়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। অতএব তাদের পরিবারের সদস্য-সদস্যা ও আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তায় তাদের বিদেশে অবস্থানের অর্থায়ন সংকট কাটানোর জন্য ওইসব দেশে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ তাদের জন্য প্রয়োজন হওয়াই স্বাভাবিক। আমার জোর সন্দেহ হচ্ছে যে, হঠাৎ করে রেমিট্যান্স-ডলারের বাজারে চাহিদার বড় ধরনের স্ফীতির পেছনে উপরে বর্ণিত ব্যাপারটাই প্রধান ভূমিকা রেখে চলেছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর হুন্ডিওয়ালাদের ব্যবসায় কিছুটা ধস নেমেছিল। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণে আগস্ট মাস থেকে যে অভূতপূর্ব জোয়ার পরিদৃষ্ট হয়ে চলেছে সেটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এই কয়েক মাসে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে অর্থ-পাচার বেশ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল।

গত কয়েক সপ্তাহ আগে লাফিয়ে রেমিট্যান্স-ডলারের বাজারে দামের বৃদ্ধি আলামত দেখিয়ে দিয়েছে যে, দেশের এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর ব্যবসা আবার উল্লেখযোগ্যভাবে চাঙা হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক রেমিট্যান্স-ডলার কেনার জন্য যে কয়েকদিন ধরে উদগ্র আগ্রহ প্রকাশ করে চলেছেÑ সেটাও তাদের এল/সি দেনা পরিশোধের সাথে সম্পৃক্ত বলে মনে করা যৌক্তিক মনে হচ্ছে না। অতএব এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর হওয়া ছাড়া বিকল্প দেখছি না।

ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ জারি করেছে যে ডলার-প্রতি ১২৩ টাকার বেশি দাম প্রদান করা যাবে না। ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি তারিখ থেকে রেমিট্যান্স ডলার এবং রফতানি আয়ের ডলারের জন্য একই দাম প্রযোজ্য হবে, কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে জরিমানা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার দাম নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি পরিত্যাগ করে দিনে দু’বার ডলারের দাম (ভিত্তিমূল্য) নির্ধারণ করে বাজারের ওপর ডলারের দামের ওঠানামাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ১২ জানুয়ারি ২০২৫ইং তারিখ থেকে কার্যকর হয়েছে। আমি এই পদক্ষেপকে সঠিক মনে করছি। (একইসাথে, ৫ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখ থেকে কিছু বড় লেনদেনের রিপোর্ট প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঠাতে হচ্ছে)। আমি এর সাথে যোগ করতে চাই, শুধু জরিমানা নয় আরো কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তদেরকে গ্রেফতার করা এবং প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের মত দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এক্সচেঞ্জ হাউজ এবং ব্যাংকগুলোর টনক নড়বে।

মনে রাখতে হবে, গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী কয়েক মাসে দেশের অর্থনীতি ‘মেল্টডাউন’ এড়াতে সক্ষম হয়েছে প্রধানত বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সের জোয়ার, রফতানির প্রবৃদ্ধি এবং আমদানি-ব্যয়ের স্থিতিশীলতার কারণে। এই তিনটি ইতিবাচক ধারাকে নস্যাৎ করার জন্য একেেশ্রণীর ব্যবসায়ীরা উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান কঠোর মনিটরিং শিথিল করা যাবে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামিয়ে রিজার্ভকে আবার প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেরানো গেছে, যেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মহোদয়কে অভিনন্দন।

কিন্তু ডলারের দামের স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ার উপক্রম হওয়ার ব্যাপারটাকে কঠোরভাবে চ্যালেঞ্জ করতেই হবে। এর ব্যত্যয় হলে আসন্ন রমজানের রোজার আগে মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনার কঠিন সংগ্রামে জয়ী হওয়া যাবে না। আরো বহুদিন ধরে বিদেশে পুঁজি-পাচারের চাহিদা চাঙা করার জন্য বিদেশে পালিয়ে থাকা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বড়সড় ‘সাবোটিয়ারের’ ভূমিকা পালন করেই যাবে। ডলার বাজার স্থিতিশীল হয়ে গেলে এবং বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণের ইতিবাচক জোয়ার অব্যাহত থাকলে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো তারা ঠেকাতে পারবে না। অতএব, আগামী এক বছর ধরে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ধারা শক্তিশালী করা, বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ উৎসাহিত করা, ডলারের বাজারে হুন্ডিওয়ালাদের দাপটকে চ্যালেঞ্জ করা এবং আমদানি-নিয়ন্ত্রণের লাগাম অটুট রাখা সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হতেই হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেকগুলো সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে অভূতপূর্ব লুন্ঠনের শিকার হওয়া আর্থিক খাতকে ‘মেল্টডাউনের’ আশংকামুক্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের ৬১টি ব্যাংকের প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও হাসিনার খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে তার আত্মীয়-স্বজন, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় অলিগার্ক ব্যবসায়ী ও ‘রবার ব্যারনে’ পরিণত হওয়া লুটেরাদেরকে পুঁজি-লুন্ঠনের অবিশ^াস্য সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এতগুলো ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান করেছিল স্বৈরশাসক হাসিনা। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত বারবার আপত্তি জানানো সত্ত্বেও এহেন খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত থেকে হাসিনাকে নিবৃত্ত করা যায়নি।

একইসাথে এটাও বলা প্রয়োজন যে, হাসিনা চট্টগ্রামের এস আলমকে সাতটি ব্যাংকের ওপর একচেটিয়া মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তার পতনের পর ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যে এই সুযোগকে ব্যবহার করে এস আলম এই সাতটি ব্যাংক থেকে দেড় লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বিদেশে পাচার করে নিয়ে গেছে। অতি সম্প্রতি হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রিমান্ডে স্বীকার করেছেন, এস আলম বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে দেড় লক্ষ কোটি টাকারও বেশি লুট করেছেÑ তার অর্ধেকটাই দিতে হয়েছে জয় ও টিউলিপকে! সালমান রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকোর বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ঋণের দায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ইং তারিখে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে যে, দেশের চলমান ৮২টি প্রকল্পে শেখ হাসিনার কোন না কোন আত্মীয়-স্বজন জড়িত রয়েছে, যেগুলোর প্রকল্প-ব্যয় একান্ন হাজার কোটি টাকারও বেশি।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গত সাড়ে পাঁচ মাসে অর্থনীতিবিদদের কাছে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়ে চলেছে যে, স্বৈরশাসক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে হাসিনা যদি ক্ষমতা হারাতে বাধ্য নাও হতেনÑ তাহলেও ‘অর্থনৈতিক মেল্টডাউনে’র অবশ্যম্ভাবী পরিণতি থেকে দেশের অর্থনীতির বিপর্যয়কে রক্ষা করতে পারতেন না হাসিনা। এদিক থেকে দেখলে মহান আল্লাহতাআলাকে শোকরিয়া জানাতেই হয় যে, তিনি আমাদেরকে আরেকটি শ্রীলংকা হওয়ার লজ্জা থেকে রক্ষা করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়োচিত নীতি-পরিবর্তন ধীরে ধীরে অর্থনীতিতে আবার গতি সঞ্চার করতে শুরু করেছে। কিন্তু বিদেশে পাচার হওয়া ২৩৪ বিলিয়ন ডলার অর্থ আদৌ দেশে ফেরত আনা যাবে বলে আমি মনে করি না। বর্তমান সরকার হয়তো রফতানি আয় এবং ক্রমবর্ধমান রেমিট্যান্স প্রবাহের মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনকে থামিয়ে দিতে সক্ষম হবে।

কিন্তু কয়েক লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পুঁজি-পাচারকারীদের মাধ্যমে যে হারিয়ে গেলো সেটা জাতি কখনোই ফিরে পাবে না। বরং যে ১৮ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশ-জাতিকে নিমজ্জিত করে পাচারকৃত অর্থের মাধ্যমে হাসিনা, তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন, কয়েকজন অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং কয়েক হাজার অর্থ-পাচারকারী তাদের বাকি জীবন বিদেশে আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দিতে পারবেÑ এই চিন্তা করলে মনের জ্বালা কয়েকগুণ বেড়ে যায় বই কী!

লেখক : ড. মইনুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর অর্থনীতি বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়।

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান
ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান
কী আছে তৌফিকার লকারে?
চট্টগ্রামসহ সারা দেশের পাহাড় ও টিলা কাটা বন্ধ করা হবে: পরিবেশ উপদেষ্টা
আরও

আরও পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান

ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল

ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা

টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা

ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের

ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি

রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি

বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম

বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান

২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার

ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার

লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭

লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭

প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু

শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু

কী আছে তৌফিকার লকারে?

কী আছে তৌফিকার লকারে?

ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা

ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা

অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা

অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা

শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা

শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা

৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি

৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি

৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ

৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ